সামনে ভোট, সংখ্যালঘু নেতাদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টায় আওয়ামী লীগ
- প্রকাশের সময় : ১০:৫৯:৩১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৩ ২৪৬ বার পঠিত
ভোটের আগে সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর করতে তৎপর হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি গত এক মাসে এসব সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। সরকারের মেয়াদের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে এখন পুরোনো প্রতিশ্রুতি, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের অঙ্গীকার করা হয়েছে। দুই পক্ষ থেকেই এই তথ্য জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়নসহ বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালে সেই নির্বাচনে টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। কিন্তু প্রধান প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করেনি তারা। এই অভিযোগ নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয় সংখ্যালঘুদের সংগঠনগুলোর ভেতরে, তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সম্পর্কের টানাপোড়েনও তৈরি হয়।
এখন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংগঠনগুলো সভা–সমাবেশ করছে। তবে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক কখনই খারাপ ছিল না—এমন দাবি করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁদের দাবিদাওয়ার বাস্তবায়নে আমরা সচেষ্ট। রাজনৈতিক বাস্তবতায় সব সময় সব দাবি মেটানো সম্ভব হয় না। তবে এখন আমরা চেষ্টা করছি।’
যদিও ক্ষমতাসীনেরা সংখ্যালঘুদের সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয় মানতে রাজি নয়, কিন্তু দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অন্যতম একটি সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেছেন, ক্ষমতাসীনেরা তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে এত দিন কোনো কথা বলেনি। এখন তারা আমাদের কথা শুনছে এবং ভোটের আগেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কথা বলছে।
সরকারের শেষ সময়ে এসে ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় আওয়ামী লীগ যে এখন সংখ্যালঘু সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ঘাটতি মেটাতে তৎপর হয়েছে, এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে, গত সেপ্টেম্বরে শুধু হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সঙ্গেই প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে অন্তত ছয়টি বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংগঠনগুলোর সঙ্গেও চলছে নানা আলোচনা।
আওয়ামী লীগের যেসব নেতা সংখ্যালঘুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, তাঁদের মধ্যে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া আছেন। এ ছাড়া আছেন আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কবির বিন আনোয়ার।
অন্যদিকে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে ২৩ সেপ্টেম্বর গণ–অনশন কর্মসূচি ছিল হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের। সাত দফা দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার অনশনের ৩৪ ঘণ্টা না পেরোতেই সেখানে যান আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কবির বিন আনোয়ার। তিনি সাত দফার মধ্যে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন।
ঠিক একই দাবিতে গত বছরের (২০২২) ২২ অক্টোবর রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের সামনে অনশন করে ঐক্য পরিষদ। সেদিন অনশন ভাঙান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তবে ওই দিন অনশনস্থলে সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের কেউ যাননি।
এবার নির্বাচনের আগমুহূর্তে সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংগঠনগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়িয়েছে ক্ষমতাসীন দল।
ঐতিহাসিকভাবেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ভালো ছিল। তাদের ভোটের বড় অংশ আওয়ামী লীগের দিকেই যায় বলে মনে করা হয়। তবে সম্প্রতি এসব সম্প্রদায়ের সংগঠনগুলোর সঙ্গে শাসক দলের দূরত্ব তৈরি হয়েছিল।
প্রতিশ্রুতি যা ছিল
আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া অঙ্গীকারের মধ্যে ছিল সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের দ্রুত বাস্তবায়ন। এ ছাড়া ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকারের স্বীকৃতি এবং তাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারার স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ, সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ভূমি কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতাসীন দল। অনগ্রসর ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, দলিত ও চা–শ্রমিকদের জন্য শিক্ষা ও চাকরিতে বিশেষ কোটা ও সুযোগ–সুবিধার ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বড় সমস্যা অর্পিত সম্পত্তি মালিকদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ শুরু হলেও এ কাজে ধীরগতির অভিযোগ রয়েছে। গত পাঁচ বছরে ২০২১ সালে শারদীয় দুর্গোৎসবসহ বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হওয়ার অভিযোগও করেন সংখ্যালঘু নেতারা। আর এসব নিপীড়ন বন্ধে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের দাবি সামনে এসেছে। কিন্তু সরকারের দিক থেকে সাড়া না পেয়ে সংখ্যালঘু সংগঠনগুলো সভা–সমাবেশ শুরু করে।
আন্দোলনের মুখে নতুন আশ্বাস
আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের সঙ্গে বসেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। পরে মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন তাঁরা। এরপরও আন্দোলন চলতে থাকে।
আগস্ট মাসের শুরু থেকেই সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও নেতাদের সঙ্গে ঐক্য পরিষদের নেতাদের বৈঠক হয়। সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে অন্তত ছয়টি বৈঠক হয়। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ঐক্য পরিষদ ঢাকায় মহাসমাবেশও ডেকেছিল। সরকারের যোগাযোগ বৃদ্ধির পর তা এক মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছেন অনেকেই। এটা ঠিক, ক্ষমতার মেয়াদের শেষ দিকে এসে তাঁরা তৎপর হয়েছেন অনেকটা।’
২০২১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের হিন্দুদের সংখ্যা ৮ শতাংশের বেশি। দেড় শতাংশ মানুষ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর।
আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে পিএইচডি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের কতগুলো নায্য দাবির এখনো সুরাহা হয়নি। ভোটের আগে সব সুরাহা হবে বলে মনে হয় না। তবে সরকারপক্ষ যে এই দাবিগুলো পূরণে সচেষ্ট আছে, তা ভোটের আগে সুস্পষ্ট হলে ভালো হয়।’
আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক অবশ্য বলেছেন, নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির আগে তাঁরা ঐক্য পরিষদসহ সংখ্যালঘুদের সঙ্গে বসবেন।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর দাবিদাওয়া:
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছিল ১৯৯৬ সালে। এর পরের বছরই জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সঙ্গে সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হয়। কিন্তু সেই চুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পার হলেও এর বাস্তবায়ন না হওয়ার অভিযোগে ক্ষোভ প্রকাশ করছে জেএসএস। আঞ্চলিক এই দলের প্রধান ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে প্রকাশ্যে তাঁর ক্ষোভের কথা বলছেন।
তবে গত আগস্ট মাস থেকে পার্বত্য চুক্তির শর্ত পূরণে আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকে বসেছেন পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহসহ সরকারের একাধিক ব্যক্তি।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের দেওয়া প্রতিশ্রুতি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এবার ভোটের আগে অন্তত সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের নিশ্চয়তা দিয়েছে বলে শুনেছি। সেটা হলে ভালো।’
পাহাড়ের বড় সমস্যা ভূমি। ১৯৯৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠিত হয়। কমিশন গঠনের ২৩ বছর পরও আইন প্রয়োগের বিধিমালা হয়নি।
গত সেপ্টেম্বর মাসেই বিধিমালা প্রণয়ন নিয়ে খোদ পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ই আগ্রহী হয়ে ওঠে। ২৭ সেপ্টেম্বর সন্তু লারমার সঙ্গে বৈঠক করেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং।
নির্বাচনের আগে ঝুলে থাকা সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশ পেয়েছেন বলে জানান মন্ত্রী বীর বাহাদুর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চুক্তির বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব সময় সজাগ আছেন। তবে কিছু সমস্যা আছে। সেগুলো আমরা নির্বাচনের আগে যতটা সম্ভব মিটিয়ে ফেলতে চাই।’
২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙামাটি থেকে জেএসএসের প্রার্থী ঊষাতন তালুকদার বিজয়ী হয়েছিলেন।
জেএসএসের এক শীর্ষ নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম ওই নির্বাচনে প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকুক। তারা তা থেকেছিল বলে আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম। যেটা ২০১৮ সালে আর হয়নি।’
ওই নেতা আরও বলেন, ‘এখন সরকারের কেউ কেউ যোগাযোগ করছেন আমাদের সঙ্গে।’
জেএসএসের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, প্রায় চার বছর ধরে জেএসএস সদস্যদের অনেকেই দেশছাড়া। তাঁদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে দলটি তাদের প্রকাশ্য সমাবেশও কমিয়ে দিয়েছিল। তবে এখন দলটি পার্বত্য এলাকায় প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড বাড়িয়েছে।
আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেএসএসের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে। সংখ্যালঘুদের বিষয়ে আমাদের আন্তরিকতা সব সময় আছে। এখন আমাদের যোগাযোগ বেড়েছে, সন্দেহ নেই।’